
নিজস্ব প্রতিবেদন, বেঙ্গল জব স্টাডি:একজন মায়ের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হল গর্ভকাল। এই সময় প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি খাবার—সন্তানের ভবিষ্যতের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। তাই গর্ভাবস্থায় কী খাবেন আর কী খাবেন না, তা জানাটা অত্যন্ত জরুরি। অনেক সময় মায়েরা না জেনে ভুল খাবার খেয়ে ফেলেন, যার ফলে ভ্রূণের বৃদ্ধি ব্যাহত হয় কিংবা জটিলতা দেখা দেয়। এই প্রতিবেদনটিতে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করব “গর্ভাবস্থায় কী খাবেন আর কী খাবেন না” এই প্রশ্নের উত্তর নিয়ে।
গর্ভাবস্থায় কী খাবেন আর কী খাবেন না – জানাটা কেন এত জরুরি?
গর্ভাবস্থায় কী খাবেন আর কী খাবেন না – এই বিষয়ে সচেতন না থাকলে মায়ের শরীরে অপুষ্টির সমস্যা দেখা দিতে পারে এবং বাচ্চার বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। গর্ভকালীন এই সময়টা মূলত তিনটি ভাগে বিভক্ত – প্রথম ত্রৈমাসিক (০-১৩ সপ্তাহ), দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক (১৪-২৬ সপ্তাহ), এবং তৃতীয় ত্রৈমাসিক (২৭-৪০ সপ্তাহ)। এই তিনটি পর্যায়ের প্রতিটিতে খাবারের গুরুত্ব আলাদা। প্রথম ত্রৈমাসিকে ক্যালরির তেমন প্রয়োজন না হলেও, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ত্রৈমাসিকে প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৪৫০ অতিরিক্ত ক্যালরি দরকার হয়।
ঘুম থেকে উঠে কী খাবেন?
গর্ভাবস্থায় কী খাবেন আর কী খাবেন না এই প্রশ্নের উত্তর শুরু হয় দিনের শুরু থেকেই। ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই এক গ্লাস জল ও রাতে ভেজানো ৪-৫টি কাঠবাদাম খাওয়া জরুরি। কাঠবাদামে থাকা ফলিক অ্যাসিড, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও জিংক ভ্রূণের মস্তিষ্ক, হৃদপিণ্ড এবং স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশে বড় ভূমিকা রাখে।
সকালের নাস্তায় কী রাখা উচিত?
সকালের খাবার হতে হবে পুষ্টিকর এবং পরিপূর্ণ। ভাত, রুটি বা ওটসের সঙ্গে মসুর ডাল, মাছ বা মুরগির মাংস রাখা উচিত। বিশেষত মসুর ডালে থাকা ফোলেট শিশুর ব্রেন বিকাশে সাহায্য করে। গর্ভাবস্থায় কী খাবেন আর কী খাবেন না – এই দিক দিয়ে সকালের খাবার যেন কোনওভাবেই বাদ না পড়ে।
মিড মর্নিং নাস্তা কেমন হওয়া উচিত?
অনেকেই ভাবেন মাঝে মাঝে খাওয়া জরুরি না, কিন্তু বাস্তবে মিড মর্নিং খাবার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সিদ্ধ ডিম ও খেজুর সবচেয়ে ভালো বিকল্প। ডিমের কুসুমে থাকা কোলিন ও ফ্যাটি অ্যাসিড শিশুর মস্তিষ্ক গঠনে সাহায্য করে। খেজুরে থাকা আয়রন রক্তস্বল্পতা প্রতিরোধে কার্যকর।
দুপুরের খাবারে কী কী রাখা দরকার?
গর্ভাবস্থায় কী খাবেন আর কী খাবেন না, এই প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করে দুপুরের খাবারের পুষ্টির উপরও। ভাতের সঙ্গে সামুদ্রিক মাছ বা লাল মাংস রাখা উচিত। সামুদ্রিক মাছে থাকা ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড বাচ্চার ব্রেইনের বিকাশে সহায়ক। পাশাপাশি শাকসবজি এবং ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল যেমন কমলা বা লেবুও খেতে হবে যাতে আয়রন শোষণ ভালো হয়।
বিকালের স্বাস্থ্যকর নাস্তা কীভাবে গঠন করবেন?
এই সময় ফাস্টফুড নয়, বরং দুধ, বাদাম, ফল বা চিকেন স্যুপ হতে পারে বিকালের উপযুক্ত সঙ্গী। দুধে থাকা ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন-ডি দাঁত, হাড় ও নখের গঠনে সহায়ক। এছাড়া ছোলা-মুড়ি, সালাদ বা পপকর্নও উপকারী বিকল্প।
রাতে কী খাওয়া ভালো?
গর্ভাবস্থায় কী খাবেন আর কী খাবেন না এই প্রশ্নে রাতে খাওয়ার সময় একটু সাবধান হতে হবে। শর্করা কমিয়ে প্রোটিনজাতীয় খাবার যেমন ডাল, ডিম, মাছ খাওয়া ভালো। পাশাপাশি হালকা সবজি বা সালাদ রাখা জরুরি। তবে খেয়াল রাখতে হবে যেন ঘুমানোর অন্তত দুই ঘণ্টা আগে রাতের খাবার শেষ হয়, নাহলে অ্যাসিডিটির সমস্যা হতে পারে।
গর্ভাবস্থায় কী কী খাবেন না – ভুল খাবারের প্রভাব
অনেক সময় না জেনে কিছু খাবার খেয়ে ফেললে গর্ভে থাকা সন্তানের উপর মারাত্মক প্রভাব পড়ে। নিচে দেওয়া টেবিলটি লক্ষ্য করুন:
খাবারের নাম | ক্ষতিকর কারণ |
---|---|
অতিরিক্ত মিষ্টি/ফাস্টফুড | ওজন ও ডায়াবেটিস বেড়ে যায় |
চা/কফি | আয়রন শোষণে বাধা দেয় |
কাঁচা পেঁপে, আনারস | ভ্রূণের ক্ষতি করতে পারে |
অতিরিক্ত লবণ | রক্তচাপ বাড়ায় ও অঙ্গ ফুলে যায় |
গর্ভাবস্থায় উপযোগী খাবারের তালিকা
গর্ভবতী মায়েদের জন্য উপযুক্ত কিছু খাবারের তালিকাও নিচে দেওয়া হল:
- ভেজানো কাঠবাদাম
- সিদ্ধ ডিম
- খেজুর
- সামুদ্রিক মাছ
- লাল মাংস (পরিমিত)
- শাকসবজি ও সালাদ
- দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার
- ভিটামিন সি যুক্ত ফল
- ওটস / মসুর ডাল
- ফলিক অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার
মা ও সন্তানের সুস্থতা নির্ভর করে সঠিক ডায়েটের উপর। “গর্ভাবস্থায় কী খাবেন আর কী খাবেন না” এই প্রশ্নের উত্তর জানা থাকলে গর্ভকালীন নানা জটিলতা অনেকটাই এড়ানো যায়। তাই নিজের শরীর ও সন্তানের সুস্থতার জন্য প্রতিটি খাবার নির্বাচন করুন সচেতনভাবে। মনে রাখবেন, একটি সঠিক ডায়েট চার্টই হতে পারে সুস্থ ও সুন্দর মাতৃত্বের প্রথম ধাপ।
গর্ভাবস্থায় কী খাবেন আর কী খাবেন না – প্রায় জিজ্ঞাসিত প্রশ্নোত্তর
প্রশ্ন ১: গর্ভাবস্থায় কি প্রতিদিন ডিম খাওয়া নিরাপদ?
উত্তর: হ্যাঁ, প্রতিদিন একটি সিদ্ধ ডিম খাওয়া নিরাপদ এবং উপকারী। ডিমের কুসুমে থাকা কোলিন ও অন্যান্য মিনারেল ভ্রূণের মস্তিষ্ক গঠনে সাহায্য করে। তবে কাঁচা বা আধসিদ্ধ ডিম খাওয়া উচিত নয়।
প্রশ্ন ২: গর্ভাবস্থায় কফি বা চা খাওয়া কি একেবারে বন্ধ করতে হবে?
উত্তর: দিনে ১ কাপ চা বা কফি খাওয়া যেতে পারে, তবে ২০০ মিলিগ্রামের বেশি ক্যাফেইন এড়িয়ে চলা ভালো। অতিরিক্ত ক্যাফেইন আয়রন শোষণে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে।
প্রশ্ন ৩: কি ধরণের ফল গর্ভাবস্থায় খাওয়া এড়ানো উচিত?
উত্তর: কাঁচা পেঁপে, আনারস ও কামরাঙ্গা এড়িয়ে চলা ভালো, বিশেষ করে প্রথম ত্রৈমাসিকে। এতে থাকা কিছু এনজাইম ভ্রূণের ক্ষতি করতে পারে।
প্রশ্ন ৪: গর্ভাবস্থায় ওজন কেমন হওয়া উচিত?
উত্তর: গর্ভাবস্থায় স্বাভাবিকভাবে ১০-১২ কেজি ওজন বাড়া স্বাভাবিক। তবে খুব দ্রুত ওজন বাড়লে বা কমলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
প্রশ্ন ৫: গর্ভাবস্থায় জল কতটা খেতে হবে?
উত্তর: দিনে অন্তত ৮-১০ গ্লাস জল খাওয়া উচিত। এটি শরীরকে হাইড্রেটেড রাখে এবং রক্তপ্রবাহ ও অ্যামনিয়োটিক ফ্লুইডের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
প্রশ্ন ৬: গর্ভাবস্থায় রাতে খাওয়ার সময় কী হতে পারে?
উত্তর: রাতে শর্করার পরিমাণ কমিয়ে প্রোটিন ও সবজিভিত্তিক হালকা খাবার খাওয়া উচিত। রাতের খাবার ঘুমানোর অন্তত ২ ঘণ্টা আগে শেষ করা ভালো।
প্রশ্ন ৭: কি ধরনের খাবার গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়?
উত্তর: অতিরিক্ত মিষ্টি, ফাস্টফুড, সাদা ভাত, মিষ্টি পানীয় এবং তৈলাক্ত খাবার গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
প্রশ্ন ৮: গর্ভাবস্থায় কি খাবারের মাধ্যমে আয়রন শোষণ বাড়ানো যায়?
উত্তর: ভিটামিন সি যুক্ত খাবার যেমন কমলা, আমলকি, লেবু ইত্যাদি আয়রনের শোষণ ক্ষমতা বাড়ায়। তাই আয়রনযুক্ত খাবারের সাথে এসব খাওয়া উচিত।